বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১১

রূপান্তর: কল্যাণী রমা


প্রকাশিতঃ http://www.sahityacafe.com/?p=686


[রূপান্তরিত করবার সময় আক্ষরিক অনুবাদ না ক’রে যেন একটি অন্যদেশীয় সংস্কৃতির পটভূমিতে নাটকটি মঞ্চায়িত করতে সুবিধা হয়, সেদিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলা রূপান্তরে পরিবেশ, পটভূমি এবং সংলাপ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, তবে চেষ্টা করা হয়েছে নাটকের মূলসুরটি অপরিবর্তিত রাখতে।]

চরিত্র:
মা
মানিক (ছেলে)
যমুনা (বড় মেয়ে)
লক্ষ্মী (ছোট মেয়ে)
প্রতিবেশী (কয়েকজন)

[কুকুরের করুণ কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চারদিক তখন অন্ধকার। আস্তে, আস্তে ফুটে উঠতে থাকে আলো। সেই সাথে শোনা যায় সমুদ্রের গর্জন।
জেলেপাড়া। একপাশে এক ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর। ঘরের চালে চালকুমড়ার লতা উঠে গেছে। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি মেলা আছে। বাঁশের বাতায় গোঁজা রয়েছে ছুরি। জালটা ছড়িয়ে রাখা। ঘরের খুঁটি আর উঠানের গাছের সাথে টাঙানো রয়েছে দড়ি। তাতে কাপড়-চোপড় মেলা। এছাড়াও চারদিকে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে জেলেদের অন্যান্য সব সরঞ্জাম ও গৃহস্থালীর জিনিসপত্র।
যমুনার বয়স বছর কুড়ি হবে। উঠানের কোণে মাটির চুলাটায় চিতই পিঠা বসিয়ে মাটির সরা দিয়ে ঢেকে দেয় ও। চুলার মুখে কাঠগুলো ঠেলে দিয়ে, শাড়ির আঁচলে হাত মুছে গাছের নিচে রাখা দড়ির খাটিয়াটাতে এসে বসে। কাঁথা সেলাই-এ মন দেয় তারপর। বেড়ার দরজাটা ফাঁক করে উঁকি দেয় লক্ষ্মী।]

লক্ষ্মী: [ নিচু, ভারী গলায়] মা কোথায় রে দিদি?

যমুনা: ওই তো ওই ঘরে শুয়ে। কি জানি ঘুম এল কিনা। কতদিন হ’ল চোখের দু’টো পাতা এক করেনি। ঠাকুর, সহায় হও।

[লক্ষ্মী আস্তে আস্তে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ঢোকে। গায়ে জড়ানো চাদরের ভিতর একটা পুঁটলি।]
যমুনা: [বসে] কিন্তু কী লুকাচ্ছিস রে, লক্ষ্মী? তোর হাতে ওটা কী?

লক্ষ্মী: পুরোহিতকাকা দিলেন। মুক্তাছড়ির কাছে পেয়েছেন। একটা লাশের সাথে নাকি ভেসে উঠেছে। লুঙ্গি, ফতুয়া, গেঞ্জি আর গামছা। আমায় বললেন কি জানিস? মিলিয়ে নিতে।

[যমুনা হঠাৎ কাঁথা সেলাই বন্ধ করে লক্ষ্মীর কথা শুনতে আগ্রহী হবে।]

লক্ষ্মী: বললেন বিশুদাদার হবে বোধ হয়।

যমুনা: [সাথে সাথে উঠে দাঁড়াবে] কী যে বলিস্‌, লক্ষ্মী! এগুলো বিশুর কী করে হবে? সাগরের অত উত্তরে ও যাবে কেন?

লক্ষ্মী: কিন্তু পুরোহিতকাকা যে বললেন, এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী তিনি। আর ওঁর নাকি কাপড়গুলো বেশ চেনা চেনাও লাগছিল। বললেন, এগুলো যদি বিশুদাদার হয় তবে মাকে বলতে ভগবানের কৃপায় ওর সৎকার হয়েছে ভালোভাবেই। আর যদি না হয় তবে, তবে আমরা যেন একদম চুপ করে থাকি। এ ব্যাপারে কোন কথা না বলাই ভালো। মা হয়ত কাঁদতে কাঁদতেই মরে যাবে।

[হঠাৎ দমকা বাতাসে লক্ষ্মীর ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে যাবে।]

যমুনা: [যমুনা লক্ষ্মীর কাছে এগিয়ে ওকে ঝাঁকি দিয়ে বলবে] তুই পুরোহিতকাকাকে বলেছিলি মানিককে মানা করতে? আবার মুক্তা খুঁজতে না যেতে?

লক্ষ্মী: উনি বললেন, “আমি ওকে মানা করব না। কিন্তু তাই বলে তোমরা ভয় পেও না। তোমাদের মা তো সারারাত প্রার্থনা করবেন। আর সাগরদেবতা অত নিষ্ঠুর নন। সবগুলো ছেলেকে অমন কেড়ে নিতে পারেন না তিনি।”

যমুনা: আচ্ছা লক্ষ্মী, কিছু শুনেছিস্‌? শাদা টিলাটার কাছে সাগরের অবস্থা কি খুবই খারাপ নাকি রে? [লক্ষ্মী সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে, চিন্তিতমুখে] বল্‌ না।

লক্ষ্মী: না এখন ততটা নয়। কিন্তু শুনলাম পশ্চিম থেকে নাকি ভয়ংকর গর্জন ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে ফুলেফেঁপে উঠছে ডাইনি। হে ভগবান! দয়া কর, কৃপা কর আমাদের। [লক্ষ্মী পুঁটলিটা নিয়ে যমুনার কাছে যাবে। ] আচ্ছা, এটা এখন খুলব দিদি?

যমুনা: একটু থাম্‌, কি জানি মা উঠে পড়েছে কিনা।

লক্ষ্মী: [ঘরের ভিতর উঁকি মেরে] হ্যাঁরে, বিছানায় উঠে বসেছে। এদিকেই তো আসছে।

যমুনা: আমায় ওটা শিগগির দে তো লক্ষ্ণী। মা জানবার আগেই খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখি গিয়ে। স্রোত উল্টোদিকে ঘুরলে মা নিশ্চয়ই বের হবে। পূব থেকে কেউ ভেসে আসছে কিনা দেখতে। তখন খুলে দেখা যাবে।

[যমুনা বেরিয়ে যাবে। মা ঢুকবে।]

মা: যমুনা হন্তদন্ত হয়ে কোথায় গেল রে লক্ষ্মী?

লক্ষ্মী: কই, কোথায়…নাতো। ওহ্‌, বোধ হয় পাশের বাড়ি একটু চিড়া আনতে গেছে। মানিক যদি আজ ডিঙা ভাসায়, ওকে তো ক’টা চিড়া গুড় বেঁধে দিতে হবে।

মা: মানিক আজ যাবে না। না-না কিছুতেই যাবে না। কি চাই আমাদের? একটু নুনভাত, আর ক’টা শুঁটকি মাছ হলেই তো বেশ চলে যায়। কেন যাবে ও? দেখছিস্‌ না কেমন জোর বাতাস উঠেছে দক্ষিণ থেকে, পশ্চিম থেকে। না-না, ও যাবে না। নিশ্চয়ই তোদের পুরোহিতকাকা থামাবেন ওকে।

লক্ষ্মী: উনি মানিককে থামাবেন না মা। আর তাছাড়া পাড়ার লোকেরাও তো বলাবলি করছিল যে মানিক যাবেই মুক্তাছড়িতে।

[যমুনা ঢুকবে]

মা: ও কোথায় রে এখন?

লক্ষ্মী: কোন কোন ডিঙি ওই দিকে যাবে তার খোঁজে গেছে বোধ হয়। এই এখনই ফিরবে নিশ্চয়।

যমুনা: কেউ আসছে মনে হচ্ছে। [বাইরে তাকিয়ে] ওই তো মানিক! বাপরে, কি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে!

মানিক: [ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকাবে] আচ্ছা, সেবার বন থেকে যে কাঠগুলো এনেছিলাম, কোথায় রে সেগুলো?

যমুনা: দেখ্‌তো লক্ষ্মী, গোয়ালঘরের পিছন দিকে আছে বোধহয়। দেখিয়ে দে তো মানিককে।

[লক্ষ্মী আর মানিক খুঁজতে এগোতেই]

মা: ওই কাঠগুলো নিস্‌নে মানিক। কাঠ লাগবে, প্রচুর কাঠ লাগবে এখানে। কাল সকালে যদি বিশুর শরীর ভেসে ওঠে সাগরে, ভেসে যদি ওঠে তার পরের দিন কিংবা অন্য যে কোন দিন, ওকে পোড়াব কি দিয়ে? কাঠ চাই, অনেক কাঠ চাই।

মানিক: কিন্তু মা, পুরানো বৈঠাটা ভেঙে গেছে যে। নতুন বৈঠাটা না হলেই তো নয়। মুক্তাছড়িতে যাব কী করে? আর দেখে নিও তুমি, ওখানে মুক্তা আমি পাবই এবার।

মা: কিন্তু লোকেই বা বলবে কী? চিতার জন্য এত ভালো কাঠ জোগাড় করেছি, অথচ পোড়ানোর সময়ই কেউ থাকবে না?

মানিক: তাছাড়া দাদার শরীর ভেসে উঠবে কোথা থেকে, নয়দিন ধরে তো সাগরে তাকিয়ে বসে থাকলাম, কই উঠল না তো। আর এখন তো জোর বাতাস বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে। ওর শরীর এদিকে আসবে কী করে?

মা: নিজে নিজে ভেসে না আসলেও ওই তো বাতাস ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে সাগর। ঢেউ উঠছে। আর রাতের আকাশে, চাঁদের পাশেই উঠছে এক তারা। ঠিক তখন যদি…কিন্তু বাছা, কী হবে মুক্তা দিয়ে? হাজার হাজার মুক্তাই যদি পাস‌, কী করব তা নিয়ে আমি? একটি ছেলেও যদি না বেঁচে থাকে আমার?

[মানিক বোঁচকা বাঁধতে থাকবে।]

মানিক: [লক্ষ্মী ও যমুনার দিকে ঘুরে] শোন্, আমি তো যাচ্ছি। তোরা গরু-বাছুরগুলোর দিকে খেয়াল রাখিস‌ একটু। আর যদি মোড়লের লোক বলদটা কিনতে আসে, ভালো দাম পেলে বিক্রি করে দিস ওটা। তোদের একার পক্ষে সব কাজ সামলে চলা হয়ত শক্ত হবে একটু। কপালও পোড়া, সংসারের সব দেখভাল করবার জন্য এ বাড়িতে পুরুষও খালি একজন!

মা: কিন্তু বাছা, তুইও বাকিদের মতো সাগরে হারিয়ে যাস্‌ যদি?…একেবারেই যে আমাদের কপাল পুড়বে রে! কী করে বাঁচব আমি? এ দু’টো মেয়েকে নিয়ে? এক বুড়ো মানুষ, মরণের দিন গুণতে গুণতে?

[মানিক ওর বোঁচকা, হুঁকা, বৈঠা ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলবে।]

মানিক: তুমি কিছু ভেব না মা। দেখো আমি দু’তিন দিনের মধ্যেই ঠিক ফিরে আসব। আর বাতাস উল্টোদিকে বইলে হয়ত একটু দেরি হবে।

মা: কী নিষ্ঠুর তুই! এত মানা করছি তবু তোর সাগরে যেতেই হবে?

যমুনা: উফ্‌, শুধু শুধু ঘ্যানঘ্যান করছ কেন? জোয়ান ছেলেদের জীবনই তো সাগরে যাবার জন্য।

মানিক: আহ্‌ কী আনন্দ! ভাবতেই রক্ত আমার নেচে উঠছে, আবার ডিঙ্গি ভাসাব সাগরের বুকে। শাদা শাদা ঢেউ নাচবে আমায় ঘিরে…আমি চ-ল-লা-ম্‌।

[মানিক বেরিয়ে যাবে]

মা: [ডুকরে কেঁদে উঠবে] চলে গেল, চলে গেল বাছা আমার। শুনল না, শুনল না কথা। হায়! আর কি দেখতে পাব না মানিককে আমার? একটু পরই আঁধার ঘনিয়ে আসবে। রাত নামবে। আর আমি? এক বুড়ি মা, এখানে বসে থাকব– একা। আসছে অমাবস্যায় আমার আর একটি ছেলেও পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে না।

যমুনা: আচ্ছা মা, তোমার কী হয়েছে বলতো? মানিক যাওয়ার সময় ক’টা ভালো কথা তো বলতে পারতে? ওকে আশীর্বাদও করলে না। সেই এক ঘ্যানঘ্যানানি।

[মা কোনদিকে খেয়াল না ক’রে চুলার কাঠ খোঁচাতে থাকে। যমুনা হঠাৎ দেখে চুলার পাশেই পড়ে আছে গুড় চিড়ার পোঁটলাটা।]

যমুনা: এই যাহ্‌, লক্ষ্মী, দাদাকে খাবারের পোঁটলাটাই তো দিতে ভুলে গেছি। কী হবে এখন!

লক্ষ্মী: ও তো স্রেফ মারা যাবে রে। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি, আবার সারারাত বাইরে থাকবে।

যমুনা: [চুলা থেকে খানিকটা চিতই পিঠা নিয়ে গুড়, চিড়ার সাথে বাঁধবে] জানতাম, জানতাম যে এমন কিছুই হবে। সারাদিন এক বুড়ির ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে কারও মাথা ঠিক থাকতে পারে?

[মা মোড়ায় বসে কপালে হাত দিয়ে দুলতে থাকে।]

যমুনা: [পোঁটলাটা মার হাতে দিয়ে] মা, যাও। এক্ষুণি মানিককে এটা দিয়ে এস গিয়ে। আর শোন, কান্নাকাটি না করে ওকে বরং একটু আশীর্বাদ কর। অমন বিপদের মুখে চলেছে। মায়ের আশীর্বাদ পেলে তাও একটু বুকে বল থাকবে ওর।

মা: [পোঁটলাটা নিয়ে] কিন্তু আমি গিয়ে ওকে ধরতে পারব তো?

যমুনা: হ্যাঁ, পারবে পারবে, তাড়াতাড়ি যাও।

মা: [কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াবে] এ কী, পা কাঁপছে যে! হেঁটে যেতে পারব তো অতদূর?

যমুনা: [চিন্তিতভাবে তার দিকে তাকিয়ে] লক্ষ্মী, মাকে ওই লাঠিটা দে তো। নয়ত পা পিছলে হঠাৎ পড়ে যাবে কোথাও।

লক্ষ্মী: কোন লাঠির কথা বলছ দিদি?

যমুনা: ওই তো সেবার বিশু মেলা থেকে যে লাঠিটা এনেছিল।

মা: [লক্ষ্মীর কাছ থেকে লাঠিটা নিতে নিতে] হে ভগবান, এই পৃথিবীতে আমরা বুড়ো বাবা মা-রা ছেলেপেলেদের জন্য কিছু রেখে যাব, এমনই তো কথা। কিন্তু আজ? জোয়ান ছেলেগুলো সব চলে যাচ্ছে। আর আমরা এই বুড়োগুলো আঁকড়ে ধরে বসে আছি তাদের স্মৃতিগুলো।

[মা আস্তে, আস্তে চলে যাবে একদিক দিয়ে। লক্ষ্মী যেতে উদ্যত হবে অন্যদিক দিয়ে।]

যমুনা: তুই আবার কোথায় চললি, লক্ষ্মী?

লক্ষ্মী: যাই নিয়ে আসি গিয়ে ওটা।

যমুনা: তাড়াতাড়ি আসিস। কে জানে মার কথা তো বলা যায় না। হয়ত এখনই ফিরে আসবে।

লক্ষ্মী: [পোঁটলাটা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে] পুরোহিতকাকা বলছিলেন উনি কাল এদিক দিয়েই যাচ্ছেন। যদি এগুলো বিশুদাদার হয়, তবে আমরা যেন তাঁকে জানাই।

যমুনা: [লক্ষ্মীর হাত থেকে পোঁটলাটা নিয়ে] কোথায়, কীভাবে এগুলো পেয়েছেন তা কি কিছু বলেছেন?

লক্ষ্মী: “ভোরবেলা সেই কাকপক্ষী জাগবারও আগে দু’টো লোক নাকি চোরাই মদ নিয়ে আসছিল। তাদেরই একজনের দাঁড়ে লাশটি লেগে উঠেছে। ওরা উত্তর পাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল,” এমনই তো বললেন পুরোহিতকাকা।

যমুনা: [পুঁটলি খুলতে চেষ্টা করবে] লক্ষ্মী, একটা ছুরি টুরি কিছু দে তো। নোনাজলে গিঁট এমন আঁট হয়ে গেছে, খালি হাতে খুলবে বলে তো মনে হচ্ছে না।

লক্ষ্মী: [ঘরের বাঁশের বাতা থেকে বের করে আনবে ছুরি] শুনেছি উত্তরের ওই পাড় এখান থেকে বহুদূর।

যমুনা: [দড়ি কাটতে কাটতে] হ্যাঁ, তা তো দূরই। সে প্রায় সাতদিনের পথ।

লক্ষ্মী: আচ্ছা, ওখান থেকে একটা মানুষের ভেসে আসতে কত সময় লাগতে পারে রে দিদি?

[যমুনা পোঁটলাটা খোলে। ওরা খুব মনোযোগ দিয়ে কাপড়গুলো দেখতে নেবে।]

যমুনা: [নিচু গলায়] হা ভগবান! লক্ষ্মী এদিকে আয় তো। ভাল করে দেখ, গত পূজায় যেটা বানিয়ে দিয়েছিলি সেটা না?

লক্ষ্মী: কই দিদি, ওহ্‌ না…না। এ হতে পারে না। আচ্ছা, শোন্‌ মানিককেও তো ঠিক এমনি একটা জামা বানিয়ে দিয়েছিলাম। আনব মানিকেরটা? দেখব দু’টো মিলিয়ে?

[দড়িতে টাঙানো কাপড়গুলোর মাঝে খুঁজতে থাকবে।] কই দেখছি না তো? গেল কোথায়?

যমুনা: ওহ্‌, হয়ত মানিক পরে গেছে। সকালে বলছিল না ওর জামা চটচটে হয়ে গেছে সাগরের নোনা জল লেগে লেগে। [ঘরের ভিতরে কোণার দিকে দেখিয়ে] আচ্ছা দেখতো ওখানে। মার ছেঁড়া একটা ব্লাউজ আছে বোধহয়। একই কাপড়ের। নিয়ে আয় তো ওটা।

[লক্ষ্মী নিয়ে আসলে ওরা মিলিয়ে দেখতে থাকবে।]

যমুনা: হা ভগবান, এ যে একই কাপড় রে, লক্ষ্মী। কিন্তু তাই বলেই নিশ্চিত হই কী করে? বিশুর মতো জামা আর কারও তো থাকতে পারে।

লক্ষ্মী: [ফতুয়াটা নিয়ে ভালো করে দেখে] এটা বিশুদাদারই দিদি, এটা বিশুদাদারই। হায়, কী হবে এখন, কী করে সামলাব মাকে। আবার মানিকটাও চলে গেল সাগরে।

যমুনা: [জামাটা নিয়ে] কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছিস তুই? এটা তো আর পাঁচটা জামার মতোই।
লক্ষ্মী: না, না দেখ ভালো করে। মনে আছে একটু কাপড় কম পড়েছিল? পকেটের ভিতরটা দিয়েছিলাম অন্য কাপড় দিয়ে।

যমুনা: [ভালো করে দেখে কেঁদে উঠবে] ওরে লক্ষ্মী, এটা তো সে জামাটাই। ভাব দেখি একবার ওই বহুদূর উত্তরে বিশুর শরীরটা ভাসছে, রাক্ষুসী সাগরটা ওকে গিলছে। ওর জন্য…ওর জন্য কাঁদবারও কেউ নেই।

লক্ষ্মী: [কাপড়গুলোর উপর আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে] সেই মানুষটা যে ছিল ভীষণ সাহসী এক জেলে, বুকে ভয় বলে কিছু ছিল না, দেখ্‌ দেখ্‌ তার অবস্থা। এই পুরানো, ছেঁড়া আর সাগরের নোনাজলে চটচটে কাপড়ের একটা টুকরা ছাড়া আর কী…আর কী বাকি থাকল তার?

যমুনা: [এক মুহূর্ত পর] দেখ্‌ তো মা এদিকে আসছে মনে হচ্ছে। পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।

লক্ষ্মী: [দেখে] হ্যাঁ দিদি, এদিকেই আসছে।

যমুনা: এগুলো সরিয়ে ফেল, সরিয়ে ফেল লক্ষ্মী। [লক্ষ্মী পোঁটলা বাঁধতে যমুনাকে সাহায্য করবে। ওটা খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে যমুনা আবার কাঁথা সেলাই করতে থাকবে। ]

লক্ষ্মী: আচ্ছা, বোঝা যাচ্ছে যে আমি কাঁদছিলাম?

যমুনা: দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাক। তোর দিকে আলো না পড়লেই তো হ’ল।

[লক্ষ্মী গিয়ে বসবে। মা খুব ধীরে, ধীরে উঠানে ঢুকবে। কারোদিকে না তাকিয়ে চুলার পাশে রাখা একটা মোড়ায় বসবে। হাতে তখনও চিঁড়ে গুড়ের পোঁটলাটা। মেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকায়। লক্ষ্মী পোঁটলাটার দিকে দেখায়।]

যমুনা: [কাঁথায় কয়েকটা ফোঁড় তুলে] মানিককে খাবারগুলো দাওনি?

[মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।]

যমুনা: কী হ’ল? মানিকের দেখা পাওনি?

[মা কেঁদেই চলে]

যমুনা: [একটু অধৈর্য হয়ে] উহ্‌, ভগবানের দোহাই! একটু থামবে, মা? কান্নাকাটি বন্ধ করে বলবে মানিককে দেখলে কিনা? শুনতে পাচ্ছ কী বলছি?

মা: [ভাঙা গলায়] আজ থেকে বুকটা আমার ভেঙে গেল রে।

যমুনা: [আগের স্বরেই] বল না, মানিককে দেখেছ?

মা: উহ্‌, কী ভয়ংকর! কী ভয়ানক! দেখিনি, আগে কখনও এমন দেখিনি।

যমুনা: [কাঁথা ছেড়ে উঠে আসবে] তোমার যে কী ভীমরতি হয়েছে, ভগবানই জানে। মানিক তো এখন সাগরের বুকে নৌকা বাইছে। ওর সামনে, পিছনে আরও অনেক নৌকা। লাল, শাদা পাল তুলে ওরা চলেছে মুক্তাছড়ির দিকে…

মা: [চমকে উঠে ভয় ভয় গলায়] হ্যাঁ, একটা নৌকা ওর সামনে, শাদা পাল তুলে চলেছে…

যমুনা: [এগিয়ে এসে] কী হয়েছে তোমার?

মা: [খুবই ধীরে ধীরে, নিচু গলায়] মনে আছে, পাশের বাড়ির নতুন বউটা কেমন দেখত, একটা মরা মানুষ এগিয়ে আসছে…বাচ্চা কোলে নিয়ে! ভয়ংকর! তার চেয়েও ভয়ংকর জিনিস দেখছি আমি আজকাল!

লক্ষ্মী ও যমুনা: কী বলছো?

[ওরা মার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে]

লক্ষ্মী: কী দেখেছো খুলে বলোনা।

মা: আমি যাচ্ছিলাম সাগরের দিকে। প্রার্থনা করতে করতে। হঠাৎ দেখি মানিক চলেছে নৌকায় করে— ওর সামনে আর একটা নৌকা। শাদা পাল খাটানো। [হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে] হে সাগরদেবতা, বিমুখ হয়ো না, আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

যমুনা: কী দেখলে সেই নৌকায়?

মা: দেখলাম বিশুকে। দেখলাম বিশু চলেছে শাদা পাল খাটানো নৌকাতে ক’রে।

যমুনা: না, না, বিশুদাদাকে দেখবে কী করে তুমি? উত্তরের পাড়ের কাছে ওর লাশ পাওয়া গেছে। পুরোহিতকাকা বলেছে ওর সৎকার হয়েছে ভালোভাবেই।

মা: [উত্তেজিত হয়ে] আমি নিজ চোখে দেখলাম তাও বলছিস এই কথা? দেখলাম গাজী গাজী, বদর বদর বলে নৌকা ছাড়ল…আমি বলতে চাইলাম, ‘সব বালাই দূর হোক, সাগরদেবতা অমঙ্গল করোনা আমার বাছার, কিন্তু কে যেন চেপে ধরল গলা। দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইল। একটা কথাও বলতে পারলাম না। হেসে হাত নেড়ে তাকাল আমার দিকে। আমি কাঁদতে কাঁদতে অবাক হয়ে দেখি ওই শাদা পালতোলা নৌকাটা করে বিশু চলেছে— চমৎকার নতুন চেক কাটা লুঙ্গি, নতুন জামা পরেছে ও। কী সুন্দর যে লাগছিল বিশুকে আমার।

যমুনা: [কাঁদতে কাঁদতে] হায়, হায়, কী হবে, কী হবে এখন আমাদের?

লক্ষ্মী: কিন্তু পুরোহিতকাকা যে বলছিলেন সাগরদেবতা অত নিষ্ঠুর নন। সবগুলো ছেলেকে উনি অমন করে কেড়ে নিতে পারেন না।

মা: [নিচু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে] ও সাগরের জানেটা কী…মানিকও চলে গেল বিশুর পিছু পিছু। মানিক, মানিক-ও হারিয়ে যাবে ওই দামাল সাগরের বুকে। যা, তোরা যা আরো কাঠ জোগাড় করে আন। আমার চিতাও তো সাজাতে হবে। বাঁচব না। আর বেশিদিন বাঁচব না আমি। বল তোরা আমাকে, সবগুলো ছেলে বুক খালি করে যাওয়ার পর কী করে বাঁচে কোন মা? আমার কে না ছিল? স্বামী ছিল, শ্বশুর ছিল, ছিল ছ’ছটা জোয়ান ছেলে। বুক চিতিয়ে যখন ঘুরত, প্রাণটা ভরে উঠত— মনে হ’ত ছয়টা তেজী ঘোড়া যেন চলেছে মাটি দাপিয়ে। আর কী কষ্টই না আমি সয়েছি এদের প্রত্যেকের জন্মের সময়। অথচ আজ? ওরা সবাই কোথায় চলে গেছে— কারও লাশ ফিরে পেয়েছি, কারও আবার তাও না। সবক’টা, সবক’টা জোয়ান তাজা ছেলে আমার হারিয়ে গেল— ওই তো ঘূর্ণিঝড়ে আমার বড়ছেলে গেল, তাকে খুঁজতে মেজোটাও উধাও। খাঁড়ির মুখে পাওয়া গেল বাছা দু’টোর শরীর। পাড়ার লোকেরা কাঁধে করে নিয়ে এল ওদের…ওই তো, ওই তো…ওই দরজা দিয়েই তো ঢুকছিল ওরা।

[মা একটু থামে। মেয়েরা চমকে ওঠে। ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে কিসের যেন শব্দ ভেসে আসে।]

লক্ষ্মী: [হঠাৎ ফিস্‌ফিস্‌ করে] শুনতে পাচ্ছিস, শুনতে পাচ্ছিস দিদি? উত্তর পূর্ব কোণ থেকে কার গোঙানি ভেসে আসছে। সাগরতীরে কেউ কাঁদছে মনে হয়।

মা: [কারো কথা না শুনে কথা চালিয়ে যাবে] তারপর গেল সেজ ছেলে, ওদের বাবা, আমার শ্বশুরমশাই। রাতের গাঢ় আঁধারে হারিয়ে গেল। পরদিন ভোরে যখন সূর্য উঠল— পাওয়া গেল না, ওদের কোন চিহ্নই কোথাও পাওয়া গেল না। তারপর, পরের ছেলেটির লাশও একদিন ভাসল এক নৌকাডুবির পর। আরও লাশের সাথে। এইতো এই এইখানে বসেছিলাম আমি। মানিককে কোলে নিয়ে। হঠাৎ দেখি দু’টো, তিনটে, চারটে এমনি করে পাড়ার মেয়েরা আসছে সব একে একে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। আমি অবাক হয়ে ওদের কাছে উঠে যেতেই দেখি ওদের পিছু পিছু আসছে পাড়ার ছেলেগুলোও। লাল টকটকে একটা ছেঁড়া নৌকার পালে মুড়িয়ে ওরা কী যেন নিয়ে আসছে। টপ্‌টপ্‌ টপ্‌টপ্‌ করে জলের ফোঁটা পড়ছে মাটিতে…কিন্তু জানিস্‌ লক্ষ্মী, আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই দিন বৃষ্টি হয়নি। খটখটে শুকনো দিন। লাল পালটায় অত জলের ফোঁটা এল কোথা থেকে? দরজা থেকে শুরু করে সারাটা ঘর জুড়ে জলের ফোঁটা। অনেক, অনেক জলের ফোঁটা।

[টপ্‌টপ্‌ করে জলের ফোঁটার শব্দ হতে হতে আলো নিভে আসবে। অন্ধকারেই ঝড়ের শব্দ হবে। তারপর আলো জ্বলে উঠবে আবার। দেখা যাবে আলুথালু বেশে পাগলের মত বসে আছে মা। লক্ষ্মী ঢুকবে।]

লক্ষ্মী: একি, তুমি ঘুমাওনি সারারাত?

মা: [আধোস্বপ্নে] হ্যাঁ, ঘুমিয়েছি তো। আমি, মানিক, বিশু, আমরা সবাই…আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। বিশুটা জানিস্‌ ভারি বোকা। ঘুমের মধ্যে কেবল আমাকে খুঁজছে।

[যমুনা ঢুকবে]

মা: কে রে? বিপিন? বিশু? নাকি অন্য আর কেউ?

যমুনা: আহ্‌, ছাড় তো। বিশু, বিশু, বিশু…বিশু নেই। ওর লাশ বহুদূরে উত্তরে পাওয়া গেছে। এখানে ও কী করে আসবে?

মা: জোয়ান ছেলেদের সে ক্ষমতা আছে রে। লাশ হয়েও ওরা ইচ্ছেমতো ভেসে বেড়াতে পারে। কিন্তু ওরা কেমন করে এত নিশ্চিত যে ওটা বিশুরই লাশ ছিল? ওর মতো আর কেউ-ও তো হতে পারে? যখন কোন লাশ ন’দিন ধরে সাগরের জলে ভাসে, তখন তার নিজের মা-ও কি তাকে চিনতে পারে? বল্‌ বল্‌ তোরা, চিনতে পারে?

যমুনা: ওটা বিশুরই ছিল, মা! ওর জামাকাপড়গুলো আমাদের দিয়ে গেছেন পুরোহিতকাকা।

মা: বিশু…

[যমুনা মাকে গিয়ে কাপড়গুলো দেবে। ওগুলো বুকে জড়িয়ে মা আস্তে, আস্তে উঠে দাঁড়াবে।]

লক্ষ্মী: [বাইরের দিকে তাকিয়ে] ওরা কী যেন বয়ে নিয়ে আসছে। জলের ফোঁটা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে
 মাটিতে।

[প্রতিবেশীরা ঢুকবে]

যমুনা: [প্রতিবেশীদের দিকে তাকিয়ে ফিস্‌ফিস্‌ করে] মানিক? মানিক নাকি?

একজন প্রতিবেশী: হ্যাঁ রে যমুনা। আমাদের মানিকই।

[মানিকের লাশ মাটিতে রাখবে প্রতিবেশীরা।]

যমুনা: কখন হ’ল? কী করে হ’ল?

প্রতিবেশী: ওই তো মুক্তাছড়ির কাছে গিয়েছিল মুক্তা খুঁজতে। হঠাৎ ঝড় এল। ওর ডিঙ্গি গেল উল্টে । আজই লাশটা ভেসে এসে লেগেছে ডাঙ্গায়।

[মা লাশের কাছে গিয়ে বসবে। মৃদুস্বরে পাড়ার মেয়েরা দুলে দুলে বিলাপ করতে থাকবে। লক্ষ্মী ও যমুনা ঘিরে বসবে মাকে। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও চারদিকে থাকবে ঘরের।]

মা: [কাউকেই যেন দেখছে না এমনভাবে মাথা তুলে] একে একে ওরা সবাই চলে গেল…এখন, এখন ওই রাক্ষুসী সাগর আর কী নেবে আমার কাছ থেকে? …হবে না, আর কারও জন্য চিন্তায় আকুল হবে না আমার মন। যখন জোর বাতাস বইবে দক্ষিণ থেকে আর ভয়ে ভয়ে প্রার্থনা করতে হবে না আমায়। তোমরা শুনতে পাবে সাগর ফুঁসে উঠছে পূব থেকে, ফুঁসছে সে পশ্চিম থেকে, দু’দিক থেকে ঢেউ এসে যেন আছড়ে পড়ছে। আর আমি? যখন অন্য মা-দের বুক কাঁপবে দুরদুর করে, এখানে বসে থাকব— চুপচাপ। কোনদিক থেকে বাতাস বইছে তা দিয়ে কী করব আমি? [লক্ষ্মীকে] গঙ্গাজলের ঘটিটা দেতো মা আমায়। হয়ত এখনও একটু জল বাকি আছে ওতে।

[লক্ষ্মী একটা ঘটি মা-কে দেবে। মা বিশুর কাপড়গুলো মানিকের লাশের কাছে রেখে জল ছিটাতে থাকবে। বলবে...]

মা: ওরে মানিক, বাছা আমার, এমন তো নয় যে তোর জন্য প্রার্থনা করিনি সাগরদেবতার কাছে। এমন তো নয় যে রাত্রির কালো অন্ধকারে সারারাত জেগে ভগবানকে ডাকিনি আমি। তবু কেন এমন হ’ল, কেন এমন হয়? তা ভালোই তো! খুঁদকুঁড়ো, একটু নুন আর সমুদ্রের ক’টা শুঁটকি মাছ জুটলেই আর কোন চিন্তা থাকবে না। কারও জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে না আমায়। রাতের পর রাত থাকতে হবে না জেগে। ঘুমাতে পারব আমি, গভীর শান্তির ঘুম।

যমুনা: [একজন প্রতিবেশীকে] তোমরা পোড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়বে নাকি তাড়াতাড়ি। বিশুদাদার কথা ভেবে মা কিছু কাঠ যোগাড় করে রেখেছিলো। সেগুলো দিয়েই নাহয় মানিককে পুড়িও।

প্রতিবেশী: তা একটু চন্দন ঘষে রেখেছ তো? কপালে ছোঁওয়াতাম!

যমুনা: না তো নেতাইকাকা…

অন্য একজনঃ সে কী? কম চিতা তো হয়নি এ বাড়িতে!

যমুনা: মা-র বয়স হয়েছে। শোকে-তাপে সবকিছু মনে রাখতে পারে না আজকাল।

[মা আস্তে, আস্তে উঠে দাঁড়াবে। লাশ আর কাপড়ের উপর ঘটির শেষ জলটুকু ছিটিয়ে দেবে।]

লক্ষ্মী: [যমুনাকে চুপিচুপি] দিদি, মা-কে দেখছিস এবার কেমন শান্ত হয়ে আছে। কিন্তু যেদিন বিশুদাদা হারিয়ে গিয়েছিলো, মনে আছে মা-র সেই চিৎকার। বড়দীঘির পাড় থেকে কান্না শোনা যাচ্ছিল। আসলে মা মনে হয় বিশুদাদাকেই বেশি ভালোবাসত।

যমুনা: [স্পষ্ট করে, ধীরে বলবে] বয়স হ’লে সবকিছুতেই মানুষ তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায় রে। কিন্তু এমন কথা বলছিস্‌ কেন? গত ন’দিন ধরে কান্নাকাটি করে আমাদের সকলকে তো মা পাগল করেই ছেড়েছে।

[সব আলো নিভু নিভু হয়ে গিয়ে মার মুখে কেবল আলো পড়বে। শূন্য গঙ্গাজলের ঘটিটা উল্টিয়ে পাশে রেখে, মানিকের গায়ে হাত দিয়ে ওর পাশে বসে]

মা: সব শেষ, সব শেষ এখন…জীবনের পাট চুকিয়ে মরণের দেশে গিয়ে ওরা সবাই একসাথে হয়েছে। মানিকের আত্মার শান্তি হোক। বিশুকেও দেখ, ভগবান। দেখ আমার বিপিন, বলাই, যদু, কেষ্ট সব সব ক’টা ছেলেকে। [মাথা নুইয়ে] লক্ষ্মীকে, আমাকে আর এই পৃথিবীতে যারা বেঁচে থাকল, তাদের সকলকে দয়া কর।

[মা থামবে, প্রতিবেশী মেয়েদের বিলাপ ও কান্নার সুর একটু বেড়ে উঠবে। তারপর ধীরে, ধীরে মিলিয়ে যাবে। মা আস্তে, আস্তে উঠে দাঁড়াবে এবং একটু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে থাকবে।]

মা: ভগবানের কৃপায় ওই দূরে উত্তরে বিশুর ভালোভাবে সৎকার হয়েছে। মানিকের চিতার জন্যও কাঠের চিন্তা নেই। এর চেয়ে আর আমরা বেশি কী চাইতে পারি? চিরকাল তো কোন মানুষ বাঁচে না। এই নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

[মা আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়বে। ধীরে, ধীরে পর্দা নামবে।]